ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পূর্ব বিজয়নগরের ঐক্যের উপর জুলুম, প্রশাসনিক অবহেলার কালো ছায়া তিন ইউনিয়নের সীমানা পুনর্বিন্যাসে।

- Update Time : ০১:০৭:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ অগাস্ট ২০২৫
- / ৪৭ Time View

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পূর্ব বিজয়নগরের ঐক্যের উপর জুলুম, প্রশাসনিক অবহেলার কালো ছায়া তিন ইউনিয়নের সীমানা পুনর্বিন্যাসে কাঁদছে তিতাস পর্ব বিজয় নগরের মাটি ও মানুষ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই ঐতিহ্যবাহী উপজেলার বুকে, যেখানে ভাষা, সংস্কৃতি আর সামাজিক বন্ধনের শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত, সেখানে নির্বাচন কমিশনের একটি খসড়া প্রস্তাব এসে পড়েছে ছুরির মতো। এই প্রস্তাবে বিজয়নগরের তিনটি ইউনিয়ন—বুধন্তী, চান্দুরা এবং হরষপুর—ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) আসন থেকে ছিন্ন করে সরাইল-আশুগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্ত শুধু ভৌগোলিক সীমানা পুনর্বিন্যাস নয়, এ যেন বিজয়নগরের হৃৎপিণ্ড ছিন্ন করার এক নিষ্ঠুর প্রয়াস। প্রায় ৯৬,০০০ ভোটারের এই তিনটি ইউনিয়ন, যারা উপজেলার মোট ভোটারের অর্ধেকেরও বেশি, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার এই প্রস্তাব জনগণের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। রাজপথে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, স্মারকলিপি—বিজয়নগরের মানুষ তাদের ঐক্য ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এক হয়ে লড়ছে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে: কেন এই সিদ্ধান্ত? কার স্বার্থে? কেন বিজয়নগরের জনগণের কণ্ঠকে উপেক্ষা করা হলো? এই প্রতিবেদন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে নেমেছে, যেখানে প্রতিটি শব্দ সত্যের পক্ষে, প্রতিটি বাক্য জনগণের কণ্ঠস্বর।
গত ৩০ জুলাই ২০২৫, নির্বাচন কমিশন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ৩৯টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের খসড়া তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় বিজয়নগরের তিনটি ইউনিয়ন—বুধন্তী, চান্দুরা এবং হরষপুর—ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন থেকে কেটে নিয়ে সরাইল-আশুগঞ্জ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২) আসনের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। নির্বাচন কমিশনের দাবি, এই পুনর্বিন্যাস ভোটার সংখ্যার ভারসাম্য, ভৌগোলিক যুক্তি এবং প্রশাসনিক কার্যকারিতা বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বিজয়নগরের মানুষ এই যুক্তিকে মানতে নারাজ।
তারা বলছে, এই সিদ্ধান্ত তাদের ঐতিহাসিক ঐক্য, সামাজিক বন্ধন এবং প্রশাসনিক সুবিধার উপর সরাসরি আঘাত। তিনটি ইউনিয়নে প্রায় ৯৬,০০০ ভোটার, যারা বিজয়নগরের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে সরাইল-আশুগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত করা মানে বিজয়নগরের রাজনৈতিক শক্তি ও প্রশাসনিক অখণ্ডতাকে খণ্ডিত করা। স্থানীয়রা এটাকে শুধু প্রশাসনিক ভুল নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে।
বিজয়নগর উপজেলা, তিতাস নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত, ২২১.১৭ বর্গ কিলোমিটারের এই অঞ্চলটি ২,৫৭,২৪৭ জনসংখ্যার (২০১১ সালের আদমশুমারি) একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রশাসনিকভাবে সুসংগঠিত এলাকা। এর ১০টি ইউনিয়ন—ইছাপুরা, চম্পকনগর, চান্দুরা, চর ইসলামপুর, পাহাড়পুর, পত্তন, বুধন্তী, বিষ্ণুপুর, সিংগারবিল এবং হরষপুর—ভৌগোলিকভাবে একটি অভিন্ন অঞ্চল গঠন করে। এই ইউনিয়নগুলোর ভাষা, সংস্কৃতি, সামাজিক বন্ধন এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক এবং কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের মাধ্যমে বিজয়নগরের সঙ্গে সদরের যোগাযোগ অত্যন্ত সুবিধাজনক। বিপরীতে, সরাইল ও আশুগঞ্জের সঙ্গে এই ইউনিয়নগুলোর ভৌগোলিক দূরত্ব বেশি, যোগাযোগ ব্যবস্থা জটিল, এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক বন্ধন ক্ষীণ। তাহলে কেন এই তিনটি ইউনিয়নকে সরাইল-আশুগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে? এই প্রশ্নই এখন বিজয়নগরের প্রতিটি মানুষের মনে ঝড় তুলেছে।
নির্বাচন কমিশনের খসড়া প্রকাশের পর থেকে বিজয়নগরের রাজপথ উত্তাল। ৩১ জুলাই থেকে শুরু করে চান্দুরা, হরষপুর এবং বুধন্তীতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন আর মহাসড়ক অবরোধ চলছে। বিজয়নগর উপজেলা সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদের ব্যানারে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবাই এক কণ্ঠে বলছে: “বিজয়নগরকে ভাঙা যাবে না!” প্ল্যাকার্ডে লেখা, “আমাদের ঐক্য ধ্বংস করবেন না!” ফেস্টুনে লেখা, “বিজয়নগর একটি স্বতন্ত্র আসন চাই!” ৩১ জুলাই দুপুরে ঢাকার আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করে বিজয়নগরবাসী। গোলাম মোস্তফা, এ কে এম গোলাম মুফতি ওসমানী, মো. জাহিদুজ্জামান চৌধুরী এবং মো. বায়েজিদ মিয়ার নেতৃত্বে একটি লিখিত আবেদন জমা দেওয়া হয় প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা মোহাম্মদ আতাউল্লাহ আরেকটি আবেদনে এই সিদ্ধান্তকে “অনাকাঙ্ক্ষিত, হতাশাজনক ও বেআইনি” বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, “বিজয়নগরের ৬৫,০০০ ভোটারকে সরাইল-আশুগঞ্জে ঠেলে দেওয়া মানে আমাদের রাজনৈতিক শক্তি ও সম্ভাবনাকে দুর্বল করা। এটা একটা ষড়যন্ত্র।”
বিজয়নগরের জনগণের অভিযোগ স্পষ্ট: এই সীমানা পুনর্বিন্যাস তাদের প্রশাসনিক ও সামাজিক ঐক্য ভেঙে দেবে। তিতাস নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত এই ১০টি ইউনিয়ন একটি অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক বন্ধন দ্বারা জড়িত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক শুধু ভৌগোলিক নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক। স্থানীয় উৎসব, মেলা, ধর্মীয় সম্প্রীতি—সবই সদরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সরাইল-আশুগঞ্জের সঙ্গে এই ইউনিয়নগুলোর কোনো সাংস্কৃতিক বা সামাজিক মিল নেই। তিনটি ইউনিয়নকে সেখানে যুক্ত করলে স্থানীয়রা প্রশাসনিক সেবা পেতে অসুবিধায় পড়বে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতাল, সরকারি কলেজ, জেলা প্রশাসনের কার্যালয়—এগুলো বিজয়নগরের মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সরাইল বা আশুগঞ্জে যেতে হলে তাদের দূরত্ব বাড়বে, সময় লাগবে, খরচ বাড়বে। এ কেমন সিদ্ধান্ত, যা জনগণের জীবনকে আরও জটিল করে?
বিজয়নগরের অর্থনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। তিতাস, সালদা এবং মেঘনা গ্যাস ফিল্ডের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস সরবরাহ করে। বিজয়নগর এই অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি অংশ। তিনটি ইউনিয়নকে বিচ্ছিন্ন করলে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য সদরের বাজার, প্রশাসনিক কার্যালয় এবং অবকাঠামো সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিচ্ছিন্নতা তাদের ব্যবসা ও জীবিকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। খসড়া তালিকা প্রকাশের আগে বিজয়নগরের জনগণের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা জনসভা হয়নি। এটা কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া? নির্বাচন কমিশনের নীতিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী, সীমানা পুনর্বিন্যাসে ভৌগোলিক সংযোগ, জনগণের মতামত এবং প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু বিজয়নগরের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা মানা হয়নি। স্থানীয়রা বলছে, এই সিদ্ধান্ত ভৌগোলিক যুক্তির পরিবর্তে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ২০১৮ সালে রংপুর-৩ আসনের মামলায় হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, সীমানা পুনর্বিন্যাসে জনগণের মতামত বিবেচনা করতে হবে। মৌলভীবাজার-৪ আসনের ক্ষেত্রে জনগণের প্রতিবাদের পর নির্বাচন কমিশন তাদের সিদ্ধান্ত সংশোধন করেছিল। তাহলে বিজয়নগরের ক্ষেত্রে কেন এই অবহেলা?
স্থানীয় নেতা মোহাম্মদ আতাউল্লাহর কথায় আগুন ঝরছে: “বিজয়নগরকে বছরের পর বছর অবহেলিত করা হয়েছে। পৌরসভা গঠন, সরকারি কলেজ স্থাপন—এসব দাবি দমিয়ে রাখতে এই সীমানা পুনর্বিন্যাস একটি ষড়যন্ত্র।” বিজয়নগরের ২ লক্ষাধিক ভোটার এটিকে একটি স্বতন্ত্র সংসদীয় আসন হিসেবে গঠনের জন্য যথেষ্ট। তাহলে কেন এই বিভাজন? কেন এই অঞ্চলের রাজনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করা হচ্ছে?
বিজয়নগরের সংগ্রাম শুধু তিনটি ইউনিয়নের জন্য নয়, এটি একটি অঞ্চলের ঐক্য, ঐতিহ্য এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াই। জনগণের দাবি স্পষ্ট: তিনটি ইউনিয়ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে ফিরিয়ে আনা হোক, অথবা বিজয়নগরকে একটি স্বতন্ত্র আসন করা হোক। তারা হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়েরের পরিকল্পনা করছে। এই সংগ্রাম শুধু বিজয়নগরের নয়, এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। নির্বাচন কমিশনের উচিত এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে জনগণের কণ্ঠকে সম্মান জানানো। বিজয়নগরের মাটি, তিতাসের জল, আর এই অঞ্চলের মানুষের ঐক্য কোনো খসড়া প্রস্তাবে ভাঙা যাবে না। এই লড়াই চলবে, যতক্ষণ না সত্য ও ন্যায়ের জয় হয়।