জহির শাহ্ , বিশেষ প্রতিনিধি, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশে সাংবাদিকতা সবসময়ই এক আলো-অন্ধকারের লড়াইয়ের নাম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেখানে সাংবাদিক হতে হলে নির্দিষ্ট ডিগ্রি, কঠোর প্রশিক্ষণ, নৈতিক মানদণ্ড এবং আইনি শর্ত পূরণ করতে হয়—বাংলাদেশে সেখানে হাতে একটি মাইক্রোফোন, গলায় একটি আইডি কার্ড, আর ভিজিটিং কার্ডেই যথেষ্ট। কোনো বিশেষ যোগ্যতা, কোনো নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ, এমনকি কোনো আইনি বাধ্যবাধকতাও নেই। এই অবাধ সুযোগ একদিকে যেমন সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে, অন্যদিকে সাংবাদিকতাকে পরিণত করেছে বিশৃঙ্খলা, মিথ্যাচার ও স্বার্থের সবচেয়ে সহজ হাতিয়ারে।
একজন ডাক্তার রোগীর চিকিৎসায় সামান্য ভুল করলে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। একজন আইনজীবী কোনো মামলায় অসতর্ক হলে ক্লায়েন্টের জীবন-ভবিষ্যৎ ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু একজন সাংবাদিকের কলম বা ক্যামেরা থেকে যদি মিথ্যা, গুজব বা বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে, সমাজের অর্ধেক ভেঙে পড়ে—তবুও তার কোনো জবাবদিহি নেই। এ এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় প্রবেশের কোনো বাধা নেই, নিয়ন্ত্রণমূলক আইন আছে অন্তত ২৫টির বেশি, কিন্তু এগুলো ব্যবহার হয় মূলত নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার জন্য, যোগ্যতা যাচাই বা পেশাগত মান উন্নয়নের জন্য নয়।
একটি জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৫৯% সাংবাদিক নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে এই পেশার নৈতিক মানদণ্ড “১০-এর মধ্যে ১”-এর কাছাকাছি। এ তথ্য সাংবাদিকতার জন্য শুধু হতাশাজনকই নয়, এটি জাতীয় সংকটের লক্ষণ।
আজকের সাংবাদিকতার বড় সংকট হলো "সংবাদ" নয়, বরং "ভিউ" বা "ক্লিক" পাওয়া। ইউটিউবের লাইভে, ফেসবুকের পেজে, কিংবা অনলাইন পোর্টালের হেডলাইনে—সত্য-মিথ্যার সীমারেখা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। “ভাইরাল” হওয়ার নেশায় অনেক সাংবাদিক যাচাই-বাছাই ছাড়াই খবর ছড়াচ্ছেন। ফলে, গুজব বাড়ছে, চরিত্র হনন হচ্ছে, এবং সমাজ বিভ্রান্তির গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার। শেখ হাসিনার আমলে সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের মালিকানা কেবল কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত হয়, যা গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ২০২৩ সালের নির্বাচনের আগে ফেক এক্সপার্ট নিয়োগ দিয়ে সরকারপন্থী ন্যারেটিভ ছড়ানোর ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেমন আল জাজিরা প্রকাশ করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ফেক নিউজ সত্য খবরের চেয়ে ছয় গুণ দ্রুত ছড়ায়। এর ফলে সমাজে বিভেদ সৃষ্টি হয়, আস্থা ভেঙে যায়, আর গণতন্ত্রের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে শত শত প্রেস ক্লাব রয়েছে, কিন্তু এর বেশিরভাগই রাজনৈতিক আনুগত্য আর আর্থিক দুর্নীতির আখড়া। সাধারণ সাংবাদিকরা মাসের পর মাস বেতন পান না, অথচ সভাপতি-সম্পাদকরা বিজ্ঞাপনের টাকা আত্মসাৎ করেন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) ১১ জন শীর্ষ সাংবাদিকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত করেছে। পাশাপাশি, সাংবাদিকদের মধ্যে গ্রুপিং, ষড়যন্ত্র, হিংসা আর অকৃতজ্ঞতার সংস্কৃতি এই পেশাকে আরও কলুষিত করছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর সংবাদপত্রগুলো কিছুটা মুক্তি পেলেও, সরকারের নিয়ন্ত্রণ কখনোই পুরোপুরি শেষ হয়নি। ১৯৯০-এর দশকে সংবাদপত্র ও টেলিভিশন এক নতুন জাগরণ আনলেও সেন্সরশিপের হাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ২০২৪ সালে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর সূচকে বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬৫তম অবস্থানে নেমে যায়। শেখ হাসিনার পতনের পরও সাংবাদিকদের ওপর হামলা থামেনি—২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেই ৬২টি হামলার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
একদিকে সাংবাদিকরা দুর্নীতি তদন্ত করতে গিয়ে নিজেরাই হয়রানির শিকার হন—যেমন ২০২১ সালে রোজিনা ইসলাম। অন্যদিকে, সাংবাদিক সমাজের মধ্যেও দুর্নীতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ৭২.৫% সাংবাদিক বিশ্বাস করেন এই পেশায় দুর্নীতি ব্যাপক। অনিয়মিত বেতন, চাকরির অনিশ্চয়তা, এবং সুরক্ষার অভাব সাংবাদিকদের ভয় ও চাপের মধ্যে কাজ করতে বাধ্য করছে।
আজকের তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবকরা, গণমাধ্যমের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন। ফেক নিউজ, রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, সেন্সরশিপ ও অনৈতিকতা এর মূল কারণ। ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেন্ডার বৈষম্য, আইনি হুমকি, এবং আর্থিক সংকট মিডিয়াকে আরও দুর্বল করে তুলছে। ফলে, যে পেশা সমাজের "বিবেক" হওয়ার কথা ছিল, তা অনেকের হাতে পরিণত হয়েছে ক্ষমতা, টাকা ও প্রভাবের খেলায়।
তবুও সব অন্ধকারের মাঝেও কিছু উজ্জ্বল তারা আছে। শহীদুল আলম, যিনি ২০২০ সালে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সত্য তুলে ধরেছেন। রোজিনা ইসলাম নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। মাহবুবুল আলম বা শাহেদ মুহাম্মদ আলীর মতো সাংবাদিকরা প্রমাণ করেছেন, সাংবাদিকতা এখনও সমাজের জন্য আশা ও আলোর বাতিঘর হতে পারে।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা—কিন্তু শুধু তখনই, যখন এটি সত্য, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে দাঁড়ায়। অন্যথায়, এটি পরিণত হয় ভয়াবহ অস্ত্রে—যা দিয়ে একদিকে মানুষকে বাঁচানো যায়, অন্যদিকে ধ্বংসও করা যায়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আজ সেই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। সামনে পথ দুটি: একদিকে নৈতিকতা, সত্য ও দায়বদ্ধতা; অন্যদিকে মিথ্যা, স্বার্থ ও দুর্নীতি। কোন পথে যাবে আমাদের সাংবাদিকতা—এটাই এখন জাতির বড় প্রশ্ন।
সম্পাদক ও প্রকাশক, মোঃ কেফায়েত উল্লাহ শরীফ, এলএলবি অনার্স। নির্বাহী সম্পাদক, সাদিয়া সুলতানা জোনাকি। সহ-নির্বাহী সম্পাদক, ডাঃ রোকেয়া বেগম। বার্তা সম্পাদক-শাহনেওয়াজ শাহ, বিএসসি অনার্স, উদ্ভিদবিজ্ঞান।সহ-বার্তা সম্পাদক, এডভোকেট সফর আলী, এলএলএম, একাউন্টিং মাস্টার্স। ইসলামি বার্তা সম্পাদক, মাওলানা সৈয়দ মোঃ আজিজুল ইসলাম, কামিল মাস্টার্স। সহ-সম্পাদক, মোঃ বোরহান উদ্দিন, ইংলিশ অনার্স মাস্টার্স। সহ-সম্পাদক, এডভোকেট মোহাম্মদ মিসবাহ উদ্দিন, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। আইন বিষয়ক উপদেষ্টা, এডভোকেট মোঃ হাদিউল হক,সিনিয়র আইনজীবী, ঢাকা জজকোর্টে। উপদেষ্টা-এডভোকেট ইশতিয়াক আহমেদ, এলএলএম, অনার্স মাস্টার্স।
অফিস: এমএস প্লাজা ২৮/সি/২ টয়েনবি সার্কুলার রোড, মতিঝিল, ঢাকা-১০০০।
ই পেপার