০৮:৫৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নাসিরনগরে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অবরুদ্ধ সড়ক

জহির শাহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
  • Update Time : ০৮:৩২:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫
  • / ৩৩ Time View

 

জহির শাহ্ | ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি | ১০ নভেম্বর ২০২৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর — এক সময় শান্তিপূর্ণ পশুপালন শিক্ষার কেন্দ্র, আজ পরিণত হয়েছে ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও হতাশার আগুনে ফুঁসে ওঠা মঞ্চে। ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ILST) শত শত শিক্ষার্থী রোববার (৯ নভেম্বর) সকালে সরাইল–নাসিরনগর–লাখাই আঞ্চলিক সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে পড়ে পুরো সড়ক—১০ কিলোমিটারজুড়ে থমকে যায় যানচলাচল, আর ধুলোয় ঢেকে যায় ‘উন্নয়ন’ আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর মুখোশ।

যে তরুণদের হাতে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার কথা, তারাই আজ রোদে-ধুলায় স্লোগান দিচ্ছে  “ন্যায্যতা চাই, অধিকার চাই!” তাদের দাবির মূলে একটিই কথা: নতুন নিয়োগবিধি আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। চার বছরব্যাপী কঠিন পরিশ্রমে অর্জিত ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক সায়েন্স ডিগ্রি আজ সরকারের চোখে যেন মূল্যহীন এক কাগজ।

শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে বলেন, “আমরা পশু চিকিৎসা, ব্রিডিং, ফিড ম্যানেজমেন্ট, ভ্যাকসিনেশন, এমনকি আধুনিক লাইভস্টক গবেষণায় প্রশিক্ষিত। অথচ চাকরির বাজারে আমাদের জায়গা নেই! মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভেঙেছেন একের পর এক।”

অভিযোগ উঠেছে—বছরের পর বছর ধরে লাইভস্টক অধিদপ্তরে যে “প্রশাসনিক সিন্ডিকেট” চলছে, তারা নাকি নিজেরাই পদে বসতে সাধারণ বিভাগ থেকে প্রার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে টেকনিক্যাল শিক্ষার্থীদের জায়গায়। ফলাফল? যারা মাঠে পশুপালন উন্নয়ন শেখে, তারা বেকার; যারা বইয়ের বাইরে এই খাত বোঝেই না, তারা অফিসে বসে নীতিনির্ধারণ করছে!

শিক্ষার্থীদের ভাষায়, “আমরা পড়েছি বাস্তব জ্ঞানের জন্য, আর সরকার চায় কাগুজে ডিগ্রিধারীকে মাঠে পাঠাতে। এটা কেবল বৈষম্য নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অন্যায়।”

অবরোধ চলাকালে স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, পিকআপ—সব থেমে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় ক্লান্ত মানুষজন রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। শিশুর কান্না, বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস, দোকানপাট বন্ধ—পুরো এলাকাজুড়ে যেন একরাশ অসহায় নীরবতা।

পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাহেল আহমেদ এবং ওসি মকছুদ আহমেদ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলোচনায় বসেন। কর্মকর্তারা বলেন, “আপনাদের দাবি আমরা লিখিতভাবে গ্রহণ করছি এবং উর্ধ্বতন দপ্তরে পাঠাবো।” প্রশাসনের সেই আশ্বাসে দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়।

কিন্তু তাদের চোখের আগুন নিভেনি—সেটা বুঝতে সময় লাগেনি কারও।
অবরোধ তুলে নিয়েও তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, “এটা সাময়িক বিরতি, শেষ নয়। যদি সরকার এই অন্যায় সংশোধন না করে, তবে আমরা সারাদেশে আন্দোলনের আগুন জ্বালাবো।”

উল্লেখ্য, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৮টি আইএলএসটি রয়েছে, যেখান থেকে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী পেশাগত প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়। অথচ নতুন নিয়োগবিধিতে তাদের জন্য একটি পদও বরাদ্দ নেই! এ নিয়ে বহুবার স্মারকলিপি, মানববন্ধন, আবেদন—সবই করা হয়েছে; কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নীরবতা এখন শিক্ষার্থীদের চোখে “অবজ্ঞা” হিসেবে ধরা পড়ছে।

নাসিরনগরের স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, “এরা আমাদের দেশের কৃষি ও পশুপালন খাতের ভবিষ্যৎ শক্তি। যদি তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে।”

একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ছেলে চার বছর পড়ে এখন রাস্তায় বসে আছে। চাকরির আবেদন করতে পারছে না। এটা কোনো উন্নত রাষ্ট্রের চিত্র নয়—এটা প্রজন্ম ধ্বংসের আয়োজন।”

অন্যদিকে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে কবে নাগাদ সংশোধন আসবে—সেই প্রশ্নে এখনো ধোঁয়াশা।

এই ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আবারও প্রমাণ করল—এ জেলার মানুষ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। প্রশাসন হয়তো সেদিনের আগুন নিভিয়ে দিতে পেরেছিল, কিন্তু বুকের ভেতর জমে থাকা আগুন এখনো দাউদাউ করছে নাসিরনগরের তরুণদের হৃদয়ে।

শিক্ষার্থীরা একটাই কথা রেখে গেছে—
“আমাদের এই ডিগ্রি যদি মূল্যহীন হয়, তবে বলুন—কেন চার বছর আমাদের জীবন দিয়ে এটা অর্জন করব? ন্যায্যতা না দিলে আমরা পড়াশোনা নয়, আন্দোলনের সিলেবাস মুখস্থ করবো।

সরকারের দপ্তর, কর্মকর্তারা, নীতিনির্ধারকরা—এখন সবার চোখ নাসিরনগরের দিকে। কারণ এই বিক্ষোভ আর কেবল সড়ক অবরোধ নয়, এটি এক প্রজন্মের আত্মসম্মানের লড়াই, যেখানে পুঁথিগত জ্ঞান নয়—ন্যায্য অধিকারই একমাত্র স্লোগান।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

নাসিরনগরে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অবরুদ্ধ সড়ক

Update Time : ০৮:৩২:৩৩ অপরাহ্ন, সোমবার, ১০ নভেম্বর ২০২৫

 

জহির শাহ্ | ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি | ১০ নভেম্বর ২০২৫

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর — এক সময় শান্তিপূর্ণ পশুপালন শিক্ষার কেন্দ্র, আজ পরিণত হয়েছে ক্ষোভ, প্রতিবাদ ও হতাশার আগুনে ফুঁসে ওঠা মঞ্চে। ইনস্টিটিউট অব লাইভস্টক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (ILST) শত শত শিক্ষার্থী রোববার (৯ নভেম্বর) সকালে সরাইল–নাসিরনগর–লাখাই আঞ্চলিক সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থবির হয়ে পড়ে পুরো সড়ক—১০ কিলোমিটারজুড়ে থমকে যায় যানচলাচল, আর ধুলোয় ঢেকে যায় ‘উন্নয়ন’ আর ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর মুখোশ।

যে তরুণদের হাতে দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার কথা, তারাই আজ রোদে-ধুলায় স্লোগান দিচ্ছে  “ন্যায্যতা চাই, অধিকার চাই!” তাদের দাবির মূলে একটিই কথা: নতুন নিয়োগবিধি আমাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে। চার বছরব্যাপী কঠিন পরিশ্রমে অর্জিত ডিপ্লোমা ইন লাইভস্টক সায়েন্স ডিগ্রি আজ সরকারের চোখে যেন মূল্যহীন এক কাগজ।

শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে বলেন, “আমরা পশু চিকিৎসা, ব্রিডিং, ফিড ম্যানেজমেন্ট, ভ্যাকসিনেশন, এমনকি আধুনিক লাইভস্টক গবেষণায় প্রশিক্ষিত। অথচ চাকরির বাজারে আমাদের জায়গা নেই! মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা ভেঙেছেন একের পর এক।”

অভিযোগ উঠেছে—বছরের পর বছর ধরে লাইভস্টক অধিদপ্তরে যে “প্রশাসনিক সিন্ডিকেট” চলছে, তারা নাকি নিজেরাই পদে বসতে সাধারণ বিভাগ থেকে প্রার্থীদের ঠেলে দিচ্ছে টেকনিক্যাল শিক্ষার্থীদের জায়গায়। ফলাফল? যারা মাঠে পশুপালন উন্নয়ন শেখে, তারা বেকার; যারা বইয়ের বাইরে এই খাত বোঝেই না, তারা অফিসে বসে নীতিনির্ধারণ করছে!

শিক্ষার্থীদের ভাষায়, “আমরা পড়েছি বাস্তব জ্ঞানের জন্য, আর সরকার চায় কাগুজে ডিগ্রিধারীকে মাঠে পাঠাতে। এটা কেবল বৈষম্য নয়, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অন্যায়।”

অবরোধ চলাকালে স্থানীয়রা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, পিকআপ—সব থেমে যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় ক্লান্ত মানুষজন রোদে দাঁড়িয়ে থাকে। শিশুর কান্না, বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস, দোকানপাট বন্ধ—পুরো এলাকাজুড়ে যেন একরাশ অসহায় নীরবতা।

পরে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাহেল আহমেদ এবং ওসি মকছুদ আহমেদ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলোচনায় বসেন। কর্মকর্তারা বলেন, “আপনাদের দাবি আমরা লিখিতভাবে গ্রহণ করছি এবং উর্ধ্বতন দপ্তরে পাঠাবো।” প্রশাসনের সেই আশ্বাসে দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীরা অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়।

কিন্তু তাদের চোখের আগুন নিভেনি—সেটা বুঝতে সময় লাগেনি কারও।
অবরোধ তুলে নিয়েও তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, “এটা সাময়িক বিরতি, শেষ নয়। যদি সরকার এই অন্যায় সংশোধন না করে, তবে আমরা সারাদেশে আন্দোলনের আগুন জ্বালাবো।”

উল্লেখ্য, সারাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৮টি আইএলএসটি রয়েছে, যেখান থেকে প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থী পেশাগত প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়। অথচ নতুন নিয়োগবিধিতে তাদের জন্য একটি পদও বরাদ্দ নেই! এ নিয়ে বহুবার স্মারকলিপি, মানববন্ধন, আবেদন—সবই করা হয়েছে; কিন্তু মন্ত্রণালয়ের নীরবতা এখন শিক্ষার্থীদের চোখে “অবজ্ঞা” হিসেবে ধরা পড়ছে।

নাসিরনগরের স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, “এরা আমাদের দেশের কৃষি ও পশুপালন খাতের ভবিষ্যৎ শক্তি। যদি তাদের অবমূল্যায়ন করা হয়, তাহলে দেশের খাদ্যনিরাপত্তাই হুমকির মুখে পড়বে।”

একজন অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ছেলে চার বছর পড়ে এখন রাস্তায় বসে আছে। চাকরির আবেদন করতে পারছে না। এটা কোনো উন্নত রাষ্ট্রের চিত্র নয়—এটা প্রজন্ম ধ্বংসের আয়োজন।”

অন্যদিকে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে কবে নাগাদ সংশোধন আসবে—সেই প্রশ্নে এখনো ধোঁয়াশা।

এই ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া আবারও প্রমাণ করল—এ জেলার মানুষ অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না। প্রশাসন হয়তো সেদিনের আগুন নিভিয়ে দিতে পেরেছিল, কিন্তু বুকের ভেতর জমে থাকা আগুন এখনো দাউদাউ করছে নাসিরনগরের তরুণদের হৃদয়ে।

শিক্ষার্থীরা একটাই কথা রেখে গেছে—
“আমাদের এই ডিগ্রি যদি মূল্যহীন হয়, তবে বলুন—কেন চার বছর আমাদের জীবন দিয়ে এটা অর্জন করব? ন্যায্যতা না দিলে আমরা পড়াশোনা নয়, আন্দোলনের সিলেবাস মুখস্থ করবো।

সরকারের দপ্তর, কর্মকর্তারা, নীতিনির্ধারকরা—এখন সবার চোখ নাসিরনগরের দিকে। কারণ এই বিক্ষোভ আর কেবল সড়ক অবরোধ নয়, এটি এক প্রজন্মের আত্মসম্মানের লড়াই, যেখানে পুঁথিগত জ্ঞান নয়—ন্যায্য অধিকারই একমাত্র স্লোগান।